ছাদ থেকে ঝরে পড়া চিঠি – পর্ব ১: নীরবতার দিকে লেখা প্রথম চিঠি
"ছাদ থেকে ঝরে পড়া চিঠি – পর্ব ১"
সন্ধ্যা নামছে শহরের আকাশে।
তপ্ত সারাদিনের পর বাতাসে একটুকরো নরম ঠাণ্ডা।
ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে একজন ছেলেকে দেখা যায়—হাতের মুঠোয় ভাঁজ করা একটি কাগজ।
তার চোখ অনেকটা নিচের দিকে তাকানো, যেন সে কোনো এক অদৃশ্য ব্যালকনির প্রতীক্ষায়।
নাম তার রাফেদ।
বয়স তেইশ।
একজন অন্তর্মুখী চিত্রশিল্পী, যে ক্যানভাসে শুধু নীল ছায়া আঁকে—কখনো সূর্য নয়, কখনো মানুষের মুখ নয়।
এই বাড়িতে সে নতুন ভাড়াটে। কিন্তু তার কাছে এই বাড়ির ছাদটাই সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।
কারণ ঠিক নিচতলার ডান পাশের ব্যালকনিটা প্রতি সন্ধ্যায় একটু একটু করে আলো জ্বালে।
আর সেই আলো জ্বালায় রুহি।
রুহির চোখে চশমা, মুখে কোনো কথা নেই, আর হাতে সবসময় একটা খাতা।
সে কথা বলে না কারো সঙ্গে, এমনকি হাসেও না।
কিন্তু প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছাদের দিকেই তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে।
এভাবেই দুই সপ্তাহ পেরিয়ে যায়।
একদিন রাফেদ সাহস করে ছোট্ট একটা চিঠি লিখে—
কাগজটা তিনভাঁজ করে, তাতে লেখে:
“তুমি কথা বলো না, ঠিক আছে।
আমি দেখছি—তোমার আলো, তোমার খাতা, তোমার চুপ করে বসে থাকা।
আমি না থাকলেও তুমি এইরকমই থেকো।
– একজন অপরিচিত”
সে চিঠিটা ভাঁজ করে ছাদ থেকে নিচে ফেলল—
নরম বাতাসে কাগজটা হেলে দুলে রুহির ব্যালকনির পাশে গিয়ে পড়ল।
রুহি নিচু হয়ে কাগজটা তুলল।
চোখে পড়ে লেখা।
তার ঠোঁটের কোণে এক বিন্দু হাসি খেলে গেল।
শহরের আলো একটু বেড়ে গেল মনে হলো।
রুহি পরদিনও সন্ধ্যায় ব্যালকনিতে বসে।
চোখে চশমা, মুখে সেই চুপ থাকা অভিব্যক্তি।
তবে আজ তার খাতার পাশে পড়ে থাকে ভাঁজ করা একটা চিঠি।
ছাদ থেকে রাফেদ দেখেন—কাগজটা বাতাসে একটু নড়ে ওঠে।
সে বুঝে যায়—সাড়া এসেছে।
রুহির চিঠি ছিল ছোট্ট, কিন্তু গভীর:
“তুমি না থেকেও আছো।
কেউ যদি কথা না বলেও বোঝে, তাহলে কি সে অপরিচিত থাকে?
– ‘নামহীন’ ”
সেই থেকে শুরু হয় তাদের অদ্ভুত চিঠির বন্ধন।
না দেখা, না ছোঁয়া—শুধু ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়া কাগজে লেখা অনুভূতি।
কখনো কবিতার মতো, কখনো প্রশ্নের মতো, কখনো দীর্ঘশ্বাসের মতো...
একদিন রুহির চিঠিতে লেখা ছিল:
“তুমি কি কোনোদিন কাউকে হারিয়েছো?”
“আমি হারিয়েছি – শব্দ, আস্থা, একটা শহর...
এখন শুধু একটা ছাদ আছে আমার মাথার ওপরে, আর তুমিও হয়তো তেমনই একজন হারিয়ে যাওয়া মানুষ।”
রাফেদ কোনোদিন এত কাছে কাউকে আসতে দেখেনি, এমনকি দূর থেকেও না।
সে লিখে:
“আমিও হারিয়েছি।
একটা মুখ, যে বলত – আমি তোমার আঁকা নীলটা বুঝি।
সে আর নেই।
কিন্তু আজকাল মনে হয়, তুমি বুঝতে পারো সেই নীল ছায়া।”
একদিন রুহির ব্যালকনি অন্ধকার।
আলো জ্বলে না।
কোনো চিঠি পড়ে না খাতার পাশে।
কয়েকদিন ধরে সেই জানালা বন্ধ।
রাফেদ ভাবেন – হয়তো অসুস্থ, হয়তো বাইরে গেছেন।
পঞ্চম দিনে তিনি আবার চিঠি লেখেন,
এইবার একটু বেশি সাহস নিয়ে:
“আমি ভয় পেয়েছি।
কেউ আবার হারিয়ে গেল বুঝি?
তুমি থাকো, না থেকেও।
যদি চিঠি পড়ে থাকো – একটা শব্দ দিও, যেকোনো কিছু।”
তিনি কাগজটা নিচে ফেলেন না।
এইবার ছাদ থেকে ব্যালকনির রেলিং লক্ষ্য করে ভাঁজ করা চিঠিটা তিনি ছুঁড়ে দেন।
কাগজটা উড়ে গিয়ে ব্যালকনির ভেতরেই পড়ে।
কিন্তু সেদিন কেউ তাকে তোলে না।
সেই রাতে রাফেদ প্রথমবার ছাদ থেকে তাকিয়ে আকাশের দিকে না দেখে, শুধু সেই ঘরটার অন্ধকারেই চেয়ে থাকেন।
এবং বুঝতে পারেন—হারিয়ে যাওয়ার চুপচাপ কষ্ট, চিঠির কাগজেও বোঝানো যায় না।
হির ব্যালকনি আলোহীন হয়ে গেছে পাঁচ দিন।
চিঠি আসে না, আলো জ্বলে না, জানালায় কেউ বসে না।
রাফেদের ভেতরে একধরনের অস্থিরতা জন্ম নেয়।
এই মেয়েটি, যার সঙ্গে সে কখনো কথাও বলেনি—সে নেই বলেই যেন পুরো ছাদটা শূন্য হয়ে গেছে।
তাকে আরেকবার চিঠি লিখতে বসে না রাফেদ।
এইবার সে সরাসরি নিচে নেমে আসে।
তৃতীয় তলায় ডানদিকের দরজা। কাঠের দরজা, ধূসর রঙ, নামপ্লেট নেই।
রাফেদ ভেবেছিল এই কাজ সে কোনোদিন করবে না।
কিন্তু আজ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে খুব হালকা করে কড়া নাড়ে।
একবার, দু’বার।
ভেতর থেকে একজন মাঝবয়সী মহিলা দরজা খুলে দেন।
চোখে ধূসর ক্লান্তি। মুখে অস্বস্তি।
– “আপনি...?”
– “আমি উপরের ভাড়াটে। ছাদ থেকে মাঝে মাঝে উনার সঙ্গে... মানে, আমি কিছু চিঠি দিয়েছিলাম রুহিকে। কিছুদিন ধরে দেখছি না...”
– “রুহি এখন এখানে থাকে না,” কণ্ঠটা কেমন ঠান্ডা, রোবটের মতো।
– “মানে?”
– “ওকে আমরা ঢাকা থেকে পাঠিয়ে দিয়েছি গ্রামের বাড়ি। কিছু সমস্যা হচ্ছিল।”
– “কী রকম সমস্যা?”
– “ব্যক্তিগত বিষয়।”
মহিলা আর কোনো কথা না বলে ধীরে দরজা বন্ধ করে দেন।
রাফেদ ফিরে আসেন নিজের ঘরে।
কিন্তু সন্ধ্যায় সে আবার ছাদে যায়, ভেতরে খচখচ করে।
সে ভাবে—রুহি কি সত্যিই নিজে চলে গেছে?
নাকি তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে?
সেই রাতে, যখন সে নিচে নামছিল, হঠাৎ করেই তার চোখে পড়ে বিল্ডিংয়ের এক কোণে পড়ে থাকা একটা খামে মোড়া কাগজ।
চিঠিটা তার নাম লেখা নেই, কিন্তু হাতের লেখা চেনা—রুহির।
“আমি যাচ্ছি। ইচ্ছায় না।
কিন্তু তুমি যদি কোনোদিন ছাদে দাঁড়িয়ে থাকো, আর আমি পাশে না থাকি—
জেনে নিও, কেউ ইচ্ছা করে অন্ধকারে থাকেনা।
কেউ কেউ শুধু আলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
– ‘নামহীন’ ”
রাফেদ চিঠিটা হাতে নিয়ে ছাদে দাঁড়ায়।
বাতাসে আজকে কেমন একটা গন্ধ—অচেনা, অনুপস্থিতির।
সে মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকায় না।
বরং জানালার নিচে একটা ছোট কাগজ রাখে।
এইবার সে লেখে না কিছু।
শুধু খালি কাগজ রেখে যায়।
কারণ সে জানে, কখনো কেউ এসে সেটা আবার ভাঁজ করে নিয়ে যাবে।
বর্ষার সকাল।
আকাশ মেঘে ঢাকা, ছাদের রেলিংয়ে ভেজা কাক বসে আছে।
রাফেদ হাতে সেই পুরোনো চিঠিটা নিয়ে দাঁড়িয়ে।
খামের কাগজে এখনো লেখা রুহির সেই শেষ শব্দগুলো—“কেউ কেউ শুধু আলো থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।”
সেই মুহূর্তে পেছন থেকে ভেসে আসে এক কণ্ঠ:
“তুমি এখনো ছাদে দাঁড়িয়ে থাকো?”
রাফেদ ঘুরে তাকায়।
রুহি।
চোখে আগের সেই চশমা, মুখে আগের মতোই চুপচাপ ভঙ্গি,
তবে আজকে তার কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ আর হাতে একটা নতুন খাতা।
রাফেদের ঠোঁট নড়ে না।
সে কিছু বলে না, শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
যেন সে যাচাই করতে চায়, এটা বাস্তব তো?
রুহি নিজেই বলে ওঠে:
“আমি ফেরত আসিনি কারো জন্য।
আমি ফিরেছি… আমার জন্য।
ছাদটা… ওই চিঠিগুলো… সবকিছু রেখে এসেছিলাম।
ভুল ছিল।”
এক মুহূর্তের নীরবতা।
– “তুমি কী আবার লিখবে?”
– “না,” রুহি বলল ধীরে। “এবার আমি শুনব, তুমি লেখো।”
সন্ধ্যা।
রুহির ব্যালকনি আবার আলোয় ভরে ওঠে।
কিন্তু এবার সে জানালার পাশে বসে থাকে না একা।
রাফেদ নিচে নেমে এসেছে, আর রুহি উঠেছে ছাদে।
দুজনে বসে থাকে ছাদের এক কোণায়, যেখানে বাতাস বেশি আসে।
কোনো চিঠি উড়ে না।
কোনো অক্ষর লিখতে হয় না।
তবু যেন চারপাশে শব্দের মতো উড়ে বেড়ায় সেই পুরোনো কথাগুলো।
রুহি বলে:
“তুমি জানো, আমি কেন চলে গিয়েছিলাম?”
“কারণ কিছু সম্পর্ককে অন্যরা ভয় পায়।
তারা বুঝতে পারে না, দুইজন মানুষ কথা না বলেও কিভাবে এত কিছু ভাগ করে নেয়।”
রাফেদ শান্ত গলায় বলল:
“তোমার চুপ করে থাকাটাই ছিল সবচেয়ে জোরালো শব্দ।”
☀️ শেষ দৃশ্য:
রুহির খাতায় লেখা—
“আজকে আমি কিছু লিখিনি।
শুধু জানালার পাশে বসে থেকেছি,
আর দূরে কোথাও ছাদে দেখেছি সেই ছেলেটাকে—
যার হাতে চিঠি নেই, তবু চোখে ভাষা ভরে আছে।”
এইভাবেই শেষ হয় প্রথম পর্ব।
তারা মুখোমুখি হলেও, শব্দে নয়—চোখে, নীরবতায়, আলোর পাশে দাঁড়িয়ে।
দ্বিতীয় পর্বের জন্য কমেন্ট করুন
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন