সাত নম্বর সিঁড়ি । যেখানে অপেক্ষা কখনো শেষ হয় না…" "একটি সিঁড়ি, কিছু পা, আর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা
নির্জনতা বোঝে না, শুধু জমে থাকে
ঢাকার এক পুরনো তিনতলা বাড়ি, নাম "শিউলি নিবাস"। নাম যতটা মিষ্টি, ভেতরের জীবন ততটাই নিস্তব্ধ। এই বাড়ির পেছন দিকটায় একটা সরু, ভাঙাচোরা সিঁড়ি আছে—সেই সিঁড়ির সাত নম্বর ধাপ যেন বছরের পর বছর কারো অপেক্ষায় বসে থাকে। ধুলোমলিন, তবুও কারো জন্য এক আশ্রয়।
রাশিদা আন্টি বলেন, “এই সাত নম্বর সিঁড়িতে বসে এক সময় এক মেয়ে গান গাইত...”
তানভীর, এই বাড়ির নতুন ভাড়াটিয়া, শুনে হেসে বলেন, “আচ্ছা, গান শুনিয়ে ভাড়া কমিয়েছিল নাকি?”
রাশিদা আন্টি মুচকি হেসে চুপ থাকেন। কিন্তু তার চোখে ভেসে ওঠে এক পুরনো সময়ের ছায়া।
তানভীর, ২৬ বছর বয়সী একজন লেখক, সদ্য হারিয়েছেন মা-বাবাকে। ঢাকার কোলাহল থেকে ছিঁটে আসা এই ছোট্ট বাড়িটাই তার নতুন ঠিকানা। একা থাকা মানুষদের মতোই তিনি কথা কম বলেন, আর রাতগুলো কাটান চুপচাপ ছাদে বসে।
একদিন সন্ধ্যায়, বৃষ্টির পরে তিনি প্রথম সেই সাত নম্বর সিঁড়িতে বসেন।
আর তখনই শুরু হয় তার দেখা পাওয়া এক মেয়ের, যে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে সিঁড়ির ঠিক পাশের দেয়ালে এসে দাঁড়ায়। তার নাম কেউ জানে না। কেউ বলে, রাইহানা। কেউ বলে, সে নাকি কথাই বলে না।
কিন্তু একদিন হঠাৎ...
❝
সিঁড়ির ধাপে বসে ছিল তানভীর,
হাতে একটা পুরোনো চিঠি।
একটা কাগজ গড়িয়ে এলো পাশ থেকে—
তাতে লেখা,
“তুমি কি জানো, আমি কেন এখানেই দাঁড়াই?”
❞
চিঠিটা কে পাঠাল?
রাইহানা কি বাস্তব, নাকি কেবলই একটা ছায়া?
আর সাত নম্বর সিঁড়িতে কীসের ইতিহাস লুকিয়ে আছে?
তানভীর সেদিন রাতে ঘুমাতে পারেনি।
বৃষ্টি ধোয়া সেই সন্ধ্যায়, সাত নম্বর সিঁড়ির ধারে পাওয়া একটা চিঠি যেন তার নিঃশব্দ রাতটাকে শব্দে ভরে দিয়েছে।
চিঠিতে লেখা ছিল:
“তুমি কি জানো, আমি কেন এখানেই দাঁড়াই?”
“এই সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেউ অপেক্ষা করেছিল।
আমি নই, কিন্তু আমি এখন তার ছায়া।”
তানভীর চিঠিটা যতবার পড়েন, ততবার কেমন অজানা এক শিহরণ তার বুকের ভেতর জমে যায়।
পরদিন সকাল।
শিউলি নিবাসের উঠোনে ছোট ছেলেমেয়েরা খেলছে। রাশিদা আন্টি ঝাঁট দিচ্ছেন, আর তানভীর ধীর পায়ে চলে এলেন সিঁড়ির দিকে।
সাত নম্বর ধাপে বসেই তিনি চারপাশে তাকালেন। হঠাৎ চোখে পড়ল, দেয়ালের একটা কোণে খুব ক্ষীণ করে খোদাই করা—
"R + A = ২০০৭"
তানভীর ফিসফিস করে বললেন, "রাইহানা আর… কে?"
এ বাড়িতে পুরনো ভাড়াটিয়াদের খোঁজ নিতে গিয়ে রাশিদা আন্টির মুখে শুনলেন একটি নাম—
“এই বাড়িতে ২০০৭ সালে এক মেয়ে ছিল, রাইহানা। মেয়েটি চুপচাপ থাকত। খুব শান্ত। তার একটা ছাদ ছিল... আর ছিল একজন... আহমেদ নামের এক ছেলে।”
“তাদের মধ্যে কিছু হয়েছিল?” — তানভীর প্রশ্ন করেন।
“হয়েছিল। আবার হয়নি।
আহমেদ একদিন চলে যায়।
রাইহানা তার পরও দাঁড়িয়ে থাকত ওই সাত নম্বর সিঁড়ির ধারে... প্রতিদিন।”“তারপর?”
“তারপর একদিন সে নিজেই হারিয়ে যায়। কেউ জানে না কোথায় গেল।”
সেই রাত।
তানভীর আবার সাত নম্বর সিঁড়িতে বসে। আবার বৃষ্টি নামে।
এবং আবার সেই মেয়েটি এসে দাঁড়ায় ছাদের কর্নারে।
এইবার সে মুখ ঘুরিয়ে তাকায়।
তার চোখে ছিল কেবল একটাই ভাষা — "তুমি কি জানতে চাও?"
তানভীর শুধু মাথা নাড়েন।
মেয়েটি পায়ের কাছে একটি খাম রেখে চলে যায়।
তানভীর চিঠি খুলে দেখেন:
তানভীর এবার বুঝতে শুরু করেন,
এই গল্পে কেবল রাইহানাই নেই।
আছে আহমেদ, আছে এক পুরনো বিশ্বাসভঙ্গ,
আর আছে সেই সাত নম্বর সিঁড়ি,
যেখানে দুঃখ জমে থাকে,
আর শব্দরা চুপচাপ কাঁদে।
তানভীর জানালার পাশে বসে আছে।
সামনে একটা টেবিল, তার ওপর চিঠিটা।
কিন্তু তার মন আটকে আছে অন্য কোথাও— সেই মেয়েটির চোখে।
শব্দহীন সেই দৃষ্টি যেন বুকের ভেতরে গোপন কিছু বলে দেয়।
তিনি কি আহমেদ?
তানভীর নিজেকে প্রশ্ন করেন।
তিনি তো কাউকে ফেলে আসেননি, তবু কেন এমন অপরাধবোধে ভুগছেন?
তানভীরের মনে পড়ে—
মাত্র তিন মাস আগে তার মা মারা গেছেন ক্যান্সারে।
তার আগে বাবা।
তখন থেকেই মানুষদের মুখের শব্দের চেয়ে চোখের চুপচাপ কথাকে বেশি বিশ্বাস করেন তিনি।
আর এই মেয়েটির চোখ?
সে যেন চোখ দিয়েই বলে—
❝
আমি কারো জন্য নয়, নিজের জন্যও দাঁড়িয়ে আছি না।
আমি শুধু দাঁড়িয়ে আছি...
কারণ কিছু সম্পর্ক থেকে পালিয়ে যাওয়া মানেই শেষ নয়।
❞
দিন পেরিয়ে যায়।
তানভীর এবার ঠিক করেন—
তিনি এই গল্প জানবেন।
তিনি শুধু পাঠক থাকবেন না,
গল্পের ভেতর ঢুকে পড়বেন।
তিনি বাড়ির পুরনো কেয়ারটেকার কাদের চাচার কাছে যান।
চাচা বলেন,
“আহমেদ খুব ভালো ছেলে ছিল। ছেলেটার চোখে ছিল শান্তি।
রাইহানা ছিল যেন এক গোধূলির আলো।
কিন্তু একদিন ওরা হঠাৎ চুপ হয়ে গেল।”
“কেন?”
“আহমেদের পরিবার জানতো না, রাইহানা এতিম।
বিয়ের কথা উঠতেই, ছেলেটার মা এসে অপমান করে গেল।
রাইহানা কিছু বলেনি। শুধু সাত নম্বর সিঁড়িতে বসে ছিল সারারাত।
পরদিন সকালেও সে ছিল...
তার পরে আর কখনো কথা বলেনি কারো সঙ্গে।”
তানভীর অবাক হয়ে শোনেন।
চোখে জল জমে।
এই মেয়ে, এই ছায়া, এখন তার দিনগুলো দখল করে নিচ্ছে।
সেদিন রাতে।
সাত নম্বর সিঁড়িতে বসে আছেন তানভীর।
একটা পুরনো ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে এসেছেন।
চালু করতেই বেজে ওঠে এক পুরনো গান:
❝
“আমি যে কারো অপেক্ষায়, জানি না ঠিক সে আসবে কিনা
তবু জানালায় বাতাস এলে, মনে হয়— তারই পদচিহ্ন।”
❞
রাইহানা পাশের দেয়ালে এসে দাঁড়ায়।
আজ সে কিছুটা এগিয়ে আসে।
তার হাতে একটা কাগজ—
সে তানভীরকে দেয় না,
শুধু বলে, প্রথমবারের মতো...
"তুমি চিঠি লিখো আমাকে।"
– তানভীর
ফিরে আসা মানেই সব কিছু ফিরে পাওয়া নয়
বৃষ্টির রাতে, সাত নম্বর ধাপে বসে আছে তানভীর।
রাইহানা আজ অনেকক্ষণ ধরেই আসেনি।
চারদিক অদ্ভুত নিস্তব্ধ।
তানভীরের বুকের ভেতর এক অস্থিরতা—
“আজ কি সে আসবে না?”
ঠিক তখনই, সিঁড়ির নিচে এক অচেনা পায়ের শব্দ।
একজন লোক— মাথায় ছাতা, চোখে গভীর ক্লান্তি।
সে সোজা গিয়ে দাঁড়ায় সাত নম্বর ধাপে।
আহমেদ।
রাশিদা আন্টি জানালা দিয়ে দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠেন,
“আহমেদ! তুমি! এতো বছর পর?”
তানভীর তাকিয়ে থাকে তার দিকে, কিছু বলতে পারে না।
রাইহানা আসে, কিন্তু এবার...
সে ছাদের কোণ থেকে নয়,
সোজা নেমে আসে সাত নম্বর ধাপে।
তিনজন মানুষ, তিনটি গল্প, একটাই জায়গা।
আহমেদ বলে,
“আমি পালিয়ে ছিলাম না। আমি সাহস করে আসতে পারিনি।
মা মারা যাওয়ার পর বুঝলাম, মায়া থেকে পালিয়ে থাকা মানেই জীবন থেকে পালানো।”
রাইহানা চুপ।
তার চোখে জল।
তবে এবার কোনো অভিযোগ নেই।
সে ধীরে ধীরে বলে,
“তুমি দেরি করে ফেলেছো আহমেদ।
আমার ভেতরের যে মেয়েটা তোমার জন্য অপেক্ষা করত, সে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।
এখন আমি শুধু দাঁড়িয়ে থাকি... অভ্যেসে।”
তানভীর বুঝে যান— তিনি গল্পের পাতা থেকে সরে যেতে হবে।
তিনি চুপচাপ চলে যান,
সিঁড়ির ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে থাকেন।
আর উপরে, সাত নম্বর ধাপে দাঁড়িয়ে রাইহানা প্রথমবারের মতো বললেন,
“তানভীর ভাই, ধন্যবাদ আপনাকে।
আপনি আমার গল্পটাকে একটা শেষ দিতে চেয়েছেন।
আজ আমি শেষ করছি।”
আহমেদ তার পায়ের কাছে একটা ছোট বাক্স রাখে।
তার মধ্যে রাখা—
পুরনো সেই চিঠি, যেখানে লেখা ছিল:
❝
“রাইহানা, আমি ভুল করেছিলাম।
কিন্তু ভালোবাসা ভুল হয় না।”
❞
রাইহানা বাক্সটা দেখে, আবার রেখে দেয় সিঁড়ির পাশে।
চোখে জল, মুখে হাসি।
শেষ দৃশ্য:
সাত নম্বর সিঁড়ির ধাপে নেই কেউ।
শুধু একজোড়া চিঠি রাখা আছে বাতাসে দুলে ওঠা পাতার পাশে।
একজন ছেলে ফিরে এসেছিল,
একজন মেয়ে অপেক্ষা করেছিল,
আর একজন চুপচাপ চলে গিয়েছিল,
কারণ সে জানতো—
❝
সব গল্প ভালোবাসা দিয়ে শুরু হয়,
কিন্তু সব ভালোবাসা গল্প হয়ে শেষ হয় না।
❞
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন