একটুকরো গোলাপ। গোলাপ হলো ভালোবাসার প্রতিক ভালোবাসা ছারা জিবন বাচেনা
🌹 এক টুকরো গোলাপ
লেখক: দার্শনিক কবি
বিকেলটা যেন একটু বেশি চুপচাপ।
তিলোত্তমা শহরের এক প্রান্তে ছিমছাম একটা লাইব্রেরি—“বুকলাইট”।
সেই লাইব্রেরির কর্নারে বসে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল আমির। কলেজ শেষ হলেও বইয়ের প্রতি তার ভালোবাসা একটুও কমেনি।
হঠাৎ করেই পাশের টেবিল থেকে ভেসে আসে এক মৃদু কণ্ঠ—
“এই বইটা আপনি আগে পড়েছেন? রুমি’র কবিতার অনুবাদ?”
আমির মুখ তোলে।
একটা মিষ্টি মুখ।
ছানিয়া।
বয়সে হয়তো এক-দু’বছরের ছোট, চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা, গলায় একটা হালকা নীল ওড়না। তার হাসিতে কেমন যেন এক অদ্ভুত নীরব আকর্ষণ।
“হ্যাঁ, পড়েছি। তবে ইংরেজি অনুবাদে অনেক অনুভূতি হারিয়ে যায়,” আমির উত্তর দেয়।
সেই মুহূর্তটা খুব সাধারণ ছিল। অথচ, আজ সাত বছর পরও আমির মনে করে— ওটাই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ “পড়ার” সময়।
ছানিয়া তখন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে। সাহিত্যে অনার্স। কবিতা ভালোবাসে, কিন্তু নিজের অনুভূতি লিখে প্রকাশ করতে ভয় পায়।
আমির ধীরে ধীরে তার বন্ধু হয়ে ওঠে।
তারা দেখা করে সেই একই লাইব্রেরিতে, মাঝে মাঝে চায়ের দোকানে।
কখনো কোনো স্পষ্ট প্রেমের প্রস্তাব হয়নি, তবু তাদের মধ্যে একটা অদৃশ্য বন্ধন গড়ে ওঠে।
তিন বছর।
তিনটা পূর্ণ বসন্ত কেটেছে তাদের একসাথে।
হাত ধরে হাঁটেনি, তবু মন একে অন্যের ভিতরে বাসা বেঁধেছে।
ছানিয়ার পরিবার রক্ষণশীল।
তাদের জন্য “ভালো ছেলে” মানে স্থায়ী চাকরি, স্থায়ী ঠিকানা, আর “সমাজে মানানসই” পরিচয়।
আমির তখনো চাকরি খুঁজছে। ছোট্ট একটা ম্যাগাজিনে ফ্রিল্যান্স লেখে, লেখালেখির স্বপ্নে বিভোর।
ছানিয়ার বাড়িতে একদিন তার পাত্র দেখা হয়।
ছানিয়া জানে—এই সংসার তার নিজের গড়া হবে না।
কিন্তু “না” বলার অধিকার তার হাতে নেই।
শেষবার ফোনে বলেছিল:
“আমার গোলাপটা রেখে দিও, আমির। হয়তো কোনোদিন... আবার দেখা হবে।”
পাঁচ বছর কেটে গেছে।
আমির এখন নামী সাহিত্য পত্রিকার সহ-সম্পাদক।
তার ডেস্কে এখনো একটা শুকনো গোলাপ রাখা—ছানিয়ার দেওয়া।
হঠাৎ একদিন এক সাক্ষাৎকারের জন্য সে যায় একটি সাহিত্য অনুষ্ঠানে।
সেখানে উপস্থিত অতিথিদের ভিড়ে হঠাৎ দেখে—
ছানিয়া।
তার কপালে এখন সিঁদুর। পাশে তার স্বামী।
ছানিয়া তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
চোখে প্রশ্ন, চোখে কৃতজ্ঞতা, চোখে এক টুকরো ফেলে আসা জীবন।
আমির শুধু মাথা নিচু করে বলে—
“তুমি যেটা বেছে নিয়েছিলে, সেটাই তোমার শান্তি হোক। আমার কাছে এক টুকরো গোলাপ থাক—তোমার মতোই নিঃশব্দ।”
কয়েকদিন পর, ছানিয়া আসে “বুকলাইট” লাইব্রেরিতে।
চুপচাপ গিয়ে বসে সেই পুরনো টেবিলে—যেখানে প্রথমবার দেখা হয়েছিল।
বইয়ের তাক ঘেঁটে একটা পুরনো খাতা খুঁজে পায়।
ভেতরে লেখা—
“৩ আগস্ট ২০১৬
ছানিয়া আজও আসেনি। তবে আমি তার প্রিয় কবিতাটা পড়ে ফেলেছি—‘সে যদি কোনোদিন ফেরে—
আমি যেন তাকাতে পারি চোখে।’”
ছানিয়া হালকা কেঁপে ওঠে। ও জানত না, আমির এতদিন তাকে এতখানি ধরে রেখেছে।
ছানিয়া মেসেঞ্জারে একটি ছোট্ট বার্তা পাঠায়—
“তুমি এখনো গোলাপটা রেখেছ?”
ঘণ্টাখানেক পরে উত্তর আসে—
“শুধু রেখিনি, লিখেছি তার গল্পও। বইমেলায় বের হচ্ছে এবার।”
ছানিয়ার চোখ ভিজে যায়।
সে জানত না, তার নীরব চলে যাওয়াটাও কারো মনে এভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়।
বইমেলা। ভিড়ের মধ্যে ছানিয়া আস্তে ধীরপায়ে এগোয়।
“এক টুকরো গোলাপ” নামের বইয়ের স্টলে দাঁড়িয়ে আছে আমির।
দু’জনের চোখে একরাশ শান্তি, এক বিন্দু দুঃখ, আর অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা।
আমির এগিয়ে দেয় বইয়ের এক কপি। ভেতরে লিখে রাখে—
“আমাদের গল্পটা বেঁচে থাকবে।
শুধু আমাদের নয়, অনেকের হয়ে।”
ছানিয়া জানে, তার সংসারে সে "খুশি" নয়, তবে কিছু দায়িত্ব আছে।
আর আমির—সে নিজের লেখালেখিতে ব্যস্ত, নিজের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবিকে গল্পে বাঁচিয়ে রেখেছে।
তারা ফের একে অপরকে ভালোবাসে না, কিন্তু—
তারা চিরদিনের আত্মা-সঙ্গী হয়ে যায়।
শেষ অধ্যায়ে, ছানিয়া একদিন লাইব্রেরিতে এসে সেই পুরনো খাতায় লেখে—
“আজ আমি গোলাপটা ফেরত দিলাম না, আমির।
কারণ আমি জানি, সে তোমার হাতেই বেশি জীবিত ছিল।”
বইয়ের শেষ পাতায় রাখা থাকে একটি শুকনো গোলাপ—
অন্তহীন ভালোবাসার একটুকরো চিহ্ন।
🔚 শেষ লাইন (সমাপ্তি):
“সব প্রেম পূর্ণতা পায় না। কিছু প্রেম কেবল থেকে যায়—এক টুকরো গোলাপ হয়ে, কোনো পুরনো পাতায়।”
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন